শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫২ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম : শুধু ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সাক্ষ্যের অভাবে শেষ হচ্ছেনা ২৮ বছর আগের ঢাকার লালবাগের আলোচিত সীমা মোহাম্মাদী হত্যা মামলার বিচার। মামলার বাদী সীমার মা ইতিমধ্যে মারা গেছেন; বাবারও মৃত্যু হয়েছে। কয়েকজন বিচারকও বদল হয়েছেন। তবে খোঁজ নেই আসামির। সীমার পরিবারের সদস্য ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, আসামি ধরতে কোনো উদ্যোগ নেই পুলিশ প্রশাসনের। সেইসঙ্গে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সাক্ষ্য দেওয়ার অনীহার কারণে আরও প্রলম্বিত হচ্ছে দীর্ঘসূত্রতায় পড়া এ মামলার বিচার। ঢাকার জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন এ মামলার বিচারক সাক্ষী হাজির করাতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য পুলিশকে দায়ী করে আদেশও লিখেছেন।
বিয়ে করতে না পেরে মোহাম্মদ আহাম্মদ ওরফে আমিন নামে একজন সীমাদের লালবাগের ১৬৬ জগন্নাথ রোডের বাড়িতে ঢুকে ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৬ এপ্রিল রাতের ওই ঘটনার পরই লালবাগ থানায় হত্যা মামলাটি করেন সীমার মা ইজহার মোহাম্মদী। দুই মাস পর ২৫ জুন আহাম্মদ ওরফে আমিনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০১ সালে অভিযোগ গঠনের পর বারবার অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়না জারি হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের তৎকালীন প্রভাষক আনোয়ার হোসেন সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হননি। গত ২৩ মার্চ থেকে শুনানির সাতটি ধার্য তারিখে ওই চিকিৎসককে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরেও তাকে আদালতে হাজির করানোর জন্য নোটিস পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আদালতে আসছেন না মামলার অভিযোগ প্রমাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সাক্ষী।
সীমার লাশের ময়নাতদন্তকারী এই চিকিৎসক বর্তমানে ধানমণ্ডির নর্দার্ন মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত বলে মামলার নথিপত্রে একটি কাগজ যুক্ত রয়েছে। ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী মো. মোতালেব হোসেন বলেন, “তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তার বর্তমান কর্মস্থলের ঠিকানা পেয়েছি মামলায় সাক্ষ্যদানকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে।” ট্রাইব্যুনালের বিচারক আশরাফ হেসেন গত ১ ডিসেম্বর অবসরে গেছেন। বিচারের ভার পড়েছে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামানের ওপর। সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী তারিখ আগামী ২৮ মার্চ। সাক্ষ্য দিতে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের অনীহার কারণে ২০০১ সালের ২৯ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের পরও মামলার বিচার কাজ বার বার পিছিয়ে যায়। এ নিয়ে ২০১৪ সালে একটি দৈনিকে খবর প্রকাশিত হলে বিষয়টি নজর কাড়ে পুলিশ ও বিচার প্রশাসনের।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক মো. আইয়ুব আলী পরবর্তীতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ২০১৪ সালের ১ অগাস্ট ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক তৎকালীন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মজিদের কাছে সাক্ষ্য দেন। ১০ দিন পরে সাক্ষ্য দেন আরও দুই পুলিশ কর্মকর্তা। ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ও নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, সাক্ষ্যগ্রহণের ৪৩টি তারিখে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর গণমাধ্যমে খবরের জেরে পুলিশ ও বিচার প্রশাসনের চাপে সাক্ষ্য দেন এই তিন পুলিশ কর্মকর্তা। এখন চিকিৎসক জবানবন্দি দিতে এলেই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা যাবে বলে জানান ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ার সাদাত শাওন। তিনি বলেন, “ট্রাইব্যুনালে কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন বিচারক আসছেন। তখন সাক্ষ্য দ্রুত শেষ করতে পারব।”
এতো দিনেও মামলার আসামি আমিনের কোনো পেশা বা ঠিকানা উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। অভিযোগপত্রে তার বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনাও নেই। এতে বলা হয়, মো. জামিলের ছেলে আমিন থাকত তার ভগ্নিপতি মাহতাব ১৪/৮ সাজাহান রোডের বাসায়। পরে মাহতাব তার কর্মস্থল গ্যাকো জোকস কোম্পানির তেজগাঁওয়ের কোয়ার্টারে উঠলে আমিনও তাদের সঙ্গে সে বাসায় থাকত। তবে আমিন প্রায়ই পুরান ঢাকার উর্দু রোডের একটি বোর্ডিংয়ে রাত্রিযাপন করত। সীমা হত্যার পরদিন থেকে আর ওই বোর্ডিংয়ে যাননি; সেখান থেকে তার ট্রাঙ্ক ও জামাকাপড় উদ্ধার করে পুলিশ। এ ট্রাইব্যুনালের আগে মামলাটির বিচার চলে ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে।
আদালতের তৎকালীন বিচারক মো. হাবিবুর রহমান ২০০৮ সালের ২৮ মে সীমার ভাই মবিনুর রহমান ও পরের বছর ২১ সেপ্টেম্বর বোন তাবাস্সুম মোহাম্মদীর সাক্ষ্য নেন। তারপর থেকে বাকি সাক্ষীদের সাক্ষ্যের অভাবে মামলার বিচার কাজ থেমে ছিল। মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, বিয়ের ১৫ দিন আগে ২২ বছর বয়সী সীমাকে খুন করার আগে আমান চিৎকার দিয়ে ‘তোর (সীমার) বিয়ের সাধ হইছে; সাধ মিটাইয়া দিব’ বলে পাগলের মতো তার বুকে ডেগার দিয়ে আঘাত করে। ঢাকার নিম্ন আদালতে ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ আইনজীবী মো. বোরহান উদ্দিন ও আমিনুল গণী টিটোর সঙ্গে কথা হয় মামলাটি নিয়ে। তাদের মতে, এমন হত্যা মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা অন্য হত্যা উৎসাহিত করে। তাই এসব মামলা বিচারে রাষ্ট্রপক্ষের অবহেলা কোনোমতেই মেনে নেওয়া ঠিক নয়। তারা জানান, সাক্ষী কোনো কারণে আদালতের সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেয়ে সাক্ষ্য এড়াতে চাইলে জরিমানাসহ কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।